হঠাৎ বিকট শব্দে ঘুম ভেঙে যাবার পর তনু বিছানা ছেড়ে অস্থির পায়চারী করতে থাকে। বোঝার চেষ্টা করে এই শব্দের উৎস। বিরতি দিয়ে চলতে থাকে গোঙানি। মনে হচ্ছে দোতলার মাঝের ফ্ল্যাট থেকে এই শব্দ হচ্ছে। বাতি নিভানো অবস্থায় বেলকনির দরজা খুলে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বুঝতে পারে না এই ব্যতিক্রমী শব্দের কারণ। আশেপাশের কোন কিছুর সাড়াশব্দ টের পাবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। পুনরায় দরজা খোলা রেখে বিছানায় মুখ মাথা বরাবর হাত দিয়ে কাত হয়ে শুয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করে। কিন্তু কোন লাভ হয় না। তনু ছোটবেলা থেকে একটি অভ্যাস রপ্ত করেছে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও একবার ঘুম থেকে জেগে উঠলে আর ঘুম আসতে চায় না। তাই চোখ বুঁজে তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় শুয়ে থাকে। কোন কিছুই বুঝে ওঠার আগেই আবার বিকট শব্দে তন্দ্রাভঙ্গ হয়। তনু চোখ বুঁজে থাকা অবস্থায় বোঝার চেষ্টা করে। কোনভাবেই উদ্ধার করতে পারে না এই শব্দের কারণ কি? সে বোঝার চেষ্টা করে প্রায় প্রতিদিনই এমন সব উদ্ভট শব্দে মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে যায়। তখন খুব একা একা লাগে। তনু কোন প্রকার উদঘাটন করতে পারেনা এই যে শব্দ তার কানে বাজে এটা কি শুধু তার সাথেই হয় নাকি সকলের সাথেই হয়। যদি সবার সাথেই এমন হয় তবে কেউ এর অনুসন্ধান করে না কেন?
পরদিন সকালে তনু তার মায়ের সাথে মোবাইল ফোনে বিষয়টি শেয়ার করে। কিন্তু আগের কথাগুলো চেপে যায়। মা তাকে সূরা পড়ে ঘুমানোর পরামর্শ প্রদান করে। তনুর মনে অজানা এক শংকা ভর করে। প্রতি রাতে ঘুমোতে যাবার আগে সুরা পড়ে ঘুমায়। তথাপিও রাতের সেই শব্দের স্মৃতি তাকে তাড়া করে ফেরে।
তনু লেখাপড়া শেষ করে সে নিজেকে আইন পেশায় নিয়োজিত করে। বাড়ি থেকে শহরে আসা যাওয়ায় রাতে গাড়ি না পাওয়ার কারণে শহরে একটি ছোট ফ্ল্যাট বাসা নিয়ে থাকে। গৃহস্থালির সকল কাজ পূর্ব থেকেই জানা থাকায় তনু কোন কাজের লোক না রেখে রান্না-বাড়া, কাপড় ধোয়া, থালাবাসন মাজা সবই নিজে নিজে করে। মা প্রতিদিন বিকেল বেলায় ফোন করে খবরাখবর নেয়। ওই পর্যন্তই। কোনদিন একাধিকবার ফোন দেয়ার পর রিসিভ না হলে পরের দিন কিংবা তারপরের দিন। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে কোন কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে গেলে দুইদিন পর টের পাবে। আর খুব বেশি দরকারের সময় আত্মীয় পরিজনকে দিয়ে খবর নেয়।
এই নিঃসঙ্গতার সময় তনু নিয়মিত কাব্য-সাহিত্য চর্চায় বেশ মনোযোগী হয়। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত থাকে। রাজনৈতিকভাবেও পূর্বের যে কোন সময়ের তুলনায় নিজেকে ব্যস্ত করে তোলে।
হঠাৎ একদিন তার মনে প্রেমের উদয় হয়। কোন একজনকে দেখে তার বেশ ভালো লাগতে শুরু করে। ভালোলাগা ক্রমশ ভালোবাসায় রূপান্তরিত হতে সময় নেয় না। মোবাইলে কথা বলতে থাকে অপর প্রান্তে থাকা স্বল্প পরিচিত কোন এক মেয়ের সাথে। কথা বলতে বলতে অভ্যস্ত হয়ে যায় দুইজন কপোত-কপোতী। একজন অপরজনের সাথে ভাব বিনিময় মেসেজ আদান প্রদান যেন স্বর্গীয় অনুভূতির রেশ বয়ে নিয়ে চলে যুগযুগান্তরের পথে। অমীমাংসিত ও অপরিণত প্রেমের মূর্ছনা যেন বাস্তবে এসে ধরা দেয়। দু'জনকে দু'জনকে উপলব্ধি করতে শুরু করে। একজনকে না দেখে আরেকজন থাকা বা কথা না বলে থাকা যেন কল্পনার অতীত। দু'জনেই চুটিয়ে প্রেম করে চলে। প্রথাগত কোন প্রেম নয়। এই প্রেমের টান এতটাই গভীর গহীনের তা প্রকাশ করা যাবে না হয়তো। তবুও তারা নিজেদের মধ্যে এক নিয়ন্ত্রিত দেয়াল তুলে রাখে। যা অদৃশ্য ও অস্পৃশ্য। যাতে একজন আরেকজনকে দেহের মোহে ভালো না বাসে। প্রেমে তারা অন্ধ হয়।
এই প্রণয় খুব বেশিদিন স্থায়ী হয় না। কোন কারণ ব্যতিরেকে তনুর প্রেমিকা তার সাথে কথা বলা কিংবা সম্পর্ক বজায় রাখতে অনীহা প্রকাশ করে। তনুর মাথা যেন বাজ পড়ে। তনু এহেন কর্মের কারণ জানতে চেয়েও কোন প্রকার জবাব পায় না। তাতে তনু আরো ক্ষিপ্ত হয়। নিজের জীবনকে আর এগুতে দিতে চায় না। প্রতিনিয়ত লোক চক্ষুর অন্তরালে কাঁদতে থাকে। কেউ যেন তার কষ্ট উপলব্ধি করতে পারে না। উপলব্ধি করার কারো দায়ও নেই।
তনু নিজেকে বুঝ প্রবোধ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে যখন তখন ছুটে যায়। তার প্রেমিকার তাতে একবিন্দুও যেন মনোযোগ আকৃষ্ট হয় না। তনু একেকদিন একেক ফোন নাম্বার থেকে ফোন করেও তার সাথে কথা বলায় ব্যর্থ হয়ে বাসায় ছুটে যায়। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে সে ক্ষেপে যায়। তনু শেষবারের মত তাকে জড়িয়ে মুখে ঠোঁটে কপালে অস্থিরভাবে আদর করতে থাকে। যেন চুমুর বৃষ্টি বর্ষিত হয়। মেয়েটি বাধা না দিয়ে তনুকে স্থির নয়নে তাকিয়ে দেখে। কিন্তু মুখে কিছুই বলে না। তনু বিদায় নিয়ে আসার পথে যেন কষ্ট আর ধরে না৷ চোখে ঝাপসা দেখে পথ চিনতে কষ্ট হয়। যেন কি হারিয়ে ফেলেছে।
তনু আবার দেখতে গেছে। তারই প্রেমিকা যে সদ্য প্রেমের খেলা থেকে নিজের নাম প্রত্যাহার করেছে। তনু যেন কিছুতে বিশ্বাস করতে চায় না৷ সে এমন করতে পারে। বুঝ প্রবোধ দেয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়।
তনু একদিন ফোন করে তার প্রেমিকাকে জীবনের সর্বস্ব দিয়ে ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হয়ে ব্যাপক মাত্রায় গালাগাল করে। মেয়েটি অস্থিরতা নিয়ে তার নিকট আত্মীয় বাড়িতে চলে যায় যোগাযোগ করেও ব্যর্থ হয়।
একদিন আচানক তনুর ফোনে ওই প্রান্ত থেকে মেয়েলিকণ্ঠ ভেসে আসে। তনু যেন আকাশের চাঁদ হাতে পায়। মনে খুশির জোয়ার বয়ে যায়। আবার দুজনের দেখা হয়। কিন্তু প্রেমের ইতির দাবী নিয়ে মেয়েটি ফোন করে।
তনুর ব্লাড প্রেসার বেড়ে যায়। হাইপার টেনশন শুরু হয়। হার্ট অস্থির লাগে। বুক ধড়ফড় করে। রাতে অনিদ্রা নিয়ে ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়। পর্যবেক্ষণ শেষে কিছু টেস্ট দিয়ে ওষুধ প্রেসস্ক্রাইব করে। সেমতে সেবন চলতে থাকে।
তনু শুক্রবার ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে অবস্থান করে। প্রায় প্রতিদিনই ফোন করে মেয়েটি দেখা করতে চাইত। এখন সেই শূন্যতা অনুভব করে তনু। কিন্তু কারো ফোন আসে না। অপর প্রান্ত থেকে কেউ বলেনা 'দুটি এসএমএস পাঠিয়ে ঘুমিয়ে যাও' কিংবা 'আজ যেন কি বাদ পড়ে গেছে'। তনু প্রতিবার ফোন করে কথা শেষ করার সময় 'আই লাভ ইউ' না বলতে মেয়েটি কেমন ধৈর্যহারা হয়ে যেত।
আজ দুপুরে হঠাৎ ডাহুকের শব্দ শুনতে পায়। গ্রামের বাড়ি সুনশান নীরবতা। গাছের পাতা পর্যন্ত নড়ে না। কেউ একজন ফোন করে তনুকে খবর দেয় মনকে শক্ত করার জন্য। অপেক্ষায় থাকে কোন দুঃসংবাদ শোনার জন্য। দুঃসংবাদ ঠিকই আসে তবু নিজেকে সংবরণ করে। স্মৃতি আওড়াতে থাকে প্রেমিকার সাথে কাটানো সময়। মেসেজ আদান-প্রদান ঘোরাঘুরির বিভিন্ন দৃশ্যপট। মেয়েটি অভিমান ভরা চাপা কষ্ট নিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে।
পরে তনু জানতে পারে হঠাৎ বুকে ব্যথা টের পায়। অস্থিরতা বাড়ে, দম আটকে আসে, একসময় চক্ষু স্থির হয়ে যায়! হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডাক্তার মৃত ঘোষণা করে৷ আজও জানা গেলো না তনুর সাথে সম্পর্ক ছেদের কারণ। আজও তনু ভুলতে পারে না মেয়েটিকে। তনু অনন্ত অসীমের অপেক্ষা নিয়ে কাটাতে চায় জীবন। যে জীবন শেষ হলেও যেন সেই মেয়েটির সাথেই তার বহুল প্রত্যাশিত গাঁটছড়া বাঁধা হয়। ডাক্তারের পরামর্শে এবং পারিবারিক চাপে পড়ে অপর কোন রমণীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। অথচ সীমাহীন কষ্ট নিয়ে সেই মোহহীন, মায়াবী সেই মুখচ্ছবি কিছুতেই ভুলতে না পারা কি মানুষের সহজাত? নাকি প্রেমিক মনের আকুতি! নির্মোহ সেই অমোঘ প্রেম আর আসেনি তনুর জীবনে।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
হঠাৎ বিকট শব্দে ঘুম ভেঙে যাবার পর তনু বিছানা ছেড়ে অস্থির পায়চারী করতে থাকে।
২৪ নভেম্বর - ২০১২
গল্প/কবিতা:
২২ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।